জামাত শিবিরের নবী কে?
সুধি পাঠকবৃন্দ আপনারা একটা জিনিস খেয়াল করে দেখবেন জামাতে ইসলামি ও ইসলামি ছাত্র শিবির কখনোই তাদের মতবাদের স্রষ্টা আবু আলা মওদুদির সমালোচনা করে না। তাদের কাছে মওদুদি সব ভুল ভ্রান্তির উর্ধে। আমি আজ এখানে এমন একটি বিষয়ের অবতারনা করব যাতে প্রশ্ন জাগতে পারে জামাতের সত্যিকার অর্থে নবী বা রাসুল কে? প্রশ্নটি কঠিন ও চমকে দেয়ার মত মনে হলেও এর উত্তর ও বিশ্লেষন সহজভাবে দেয়া যায়।
আমরা প্রায়শই শুনে আসছি বিভিন্ন আলেম ও ইসলামি দলগুলোর নেতাদের মুখ থেকে - জামাত ও ইসলাম এক নয়। খেলাফত আন্দোলনের সহকারী মহাসচিব মুজিবুর রহমান হামিদী বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমকে কয়েকমাস আগে দেয়া ইন্টারভিউতে এই কথাটি আবার জোর দিয়ে বলেছেন। তিনি আরো বলেছেন, “জামাতের সাথে ঐক্যের প্রশ্নই আসে না। আমরা জামাতকে যতটুকু ঘৃনা করি, আওয়ামি লীগও জামাতকে ততটুকু ঘৃনা করে না। আমরা জানি জামাতের সাথে ইসলামের বিরোধ কোথায়। এটা আমরা আমাদের অন্তর দিয়ে বুঝি।” একটি শ্লোগানের কথা আমার মনে পড়ছে - মওদুদিবাদ নিপাত যাক, ইসলাম মুক্তি পাক। অনেক আলেম জামাতে ইসলাম না বলে জামাতে মওদুদি বলতে পছন্দ করেন। এর পিছনে অবশ্যই যৌক্তিক কারন আছে। আমরা ইতিহাস থেকে জানি যে জামাতের গুরু আবু আলা মওদুদি জামাতের জন্মলগ্ন থেকেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আহমাদিয়াদের অমুসলিম ঘোষনা করে তাদের নানা পদ্ধতিতে নীপিড়ন করার চেষ্টা করে এসেছিল। পাকিস্তানে ভয়াবহ দাঙ্গা লাগিয়ে আহমাদিয়াদের হতাহত ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার কারনে মওদুদিকে ফাসির আদেশ পর্যন্ত দিতে বাধ্য হয়েছিল পাকিস্তানের সরকার যা পরবর্তিতে অযাচিত সৌদি হস্তক্ষেপে বাতিল হয়ে গিয়েছিল। এই ফাসিটি যদি কার্যকর হত আজ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ইতিহাসে অনেক কিছুই হয়ত ভিন্নভাবে লেখা হত। ন্যুনপক্ষে জামাত ও শিবির নামক বিষাক্ত ভাইরাসটির এত ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব হত না।
জামাত যে কারন দেখিয়ে আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষিত করে সমাজে শান্তি বিনষ্ট করার চেষ্টা করে যাচ্ছে বিভিন্ন সময়ে, সেই একই ধরনের অভিযোগে শিবির ও জামাতের ইসলামত্বও খারিজ করে দেয়া যায়। ব্যাপারটি চমকে দেয়ার মত হলেও সত্যি।
আমি তাবলিগ জামাত ও তাবলিগের বাইরে অনেক আলেমের কাছে মুসলমান হওয়ার প্রধান শর্ত হিসেবে এরকম শুনেছি - যদি কেউ কোরানের একটি মাত্র আয়াত অস্বীকার করে অথবা সহীহ হাদিসের একটিও অস্বীকার করে তাহলে তার মুসলমানিত্ব খারিজ হয়ে যাবে। কোরান বা সহীহ হাদিসের বিরুদ্ধে অবস্থানকারির স্থান ইসলামে নেই। আসুন এর আলোকে মওদুদির লেখার কিছু অংশে আমরা আলোকপাত করি।
মওদুদি তার রাসায়েল ওয়া মাসায়েল গ্রন্থে ১৩৫১ হিজরি সংস্করনের পৃষ্ঠা ৫৭ লিখেছেন (সালটির উল্লেখ করলাম কারন নতুন সংস্করনে জামাতিরা অরিজিনাল মওদুদির বিতর্কিত অংশগুলো বাদ দিয়ে থাকতে পারে): “রসুলুল্লাহ (সা:) মনে করতেন দজ্জাল উনার জিবদ্দশায় বা কাছাকাছি কোন সময়ে আবির্ভূত হবে। কিন্তু ১৩৫০ বছর পেরিয়ে গেল, অনেক প্রজন্ম আসল আর গেল, তথাপি দজ্জালের আগমন ঘটল না। সুতরাং এটি নিশ্চিত যে রসুলুল্লাহ (সা:) এব্যাপারে যা মনে করতেন তা সত্য বলে প্রমানিত হলো না।” মওদুদি ১৩৬২ হিজরির পরবর্তি সংস্করনে আরো যোগ করেন: “সত্যিই ১৩৫০ বছর পেরিয়ে গেল, তথাপি দজ্জালের দেখা মিলল না, সুতরাং এটাই বাস্তবতা।”
মওদুদি এ সম্বন্ধে আরো লিখেছেন: “এটি নিশ্চিত সত্য যে দজ্জাল সংক্রান্ত রসুলুল্লাহ (সা:) এর হাদিসগুলো শুধু উনার ব্যক্তিগত মতামত এবং নিজস্ব বিশ্লেষন থেকে দেয়া অভিমত, উনার তরফ থেকে এগুলো সন্দেহযুক্ত অবতারনা।”
সহীহ বোখারি শরিফে প্রায় ১২টির মত ও সহীহ মুসলিম শরিফে তার চেয়েও বেশি হাদিসে রসুলু্ল্লাহ (সা:) দজ্জালের বিষয় এনেছেন। এটি একটি বা দুটি হাদিসের ব্যাপার নয়। আমি মওদুদির রসুলুল্লাহ (সা:) এর দজ্জালের আগমন নিয়ে সহীহ হাদিসগুলোর পরিষ্কার অস্বীকার করা সুধি পাঠকদের নজরে আনছি। নিজেদের ধর্মিয় রাজনৈতিক দল বলে দাবিদার একটি দলের প্রতিষ্ঠাতা ও তাদের আধ্যাত্মিক ও তাত্বিক গুরুর এটি নিঃসন্দেহে ভয়াবহ ধৃষ্টতামূলক কাজ। রসুল (সা:) যার সম্বন্ধে আল্লাহ সূরা নজমের ৩-৪ আয়াতে বলেছেন: “সে তার নিজের ইচ্ছায় কোনকিছু বলে না, শুধুমাত্র (আল্লাহর তরফ থেকে) ওহিই তাকে অনুপ্রানিত করে।”
সম্মানিত পাঠকদের কাছে প্রশ্ন রাখছি - আপনারা কি রসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সহীহ হাদিসগুলোকে গ্রহন করবেন নাকি এগুলোকে অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখানকারি ভ্রান্ত মতবাদি মওদুদিকে গ্রহন করবেন? মওদুদি রসুলের দজ্জাল আগমনের হাদিসগুলোকে গল্পকাহিনী বলে শুধু জঘন্য রকমের ধৃষ্টতাই দেখান নি, এই অপরাধে তার ইসলামত্ব খারিজ হয়ে যায়। তাকে যারা অন্ধভাবে অনুসরন করছে তাদের বেলাতেও কি একথা প্রযোজ্য নয়? পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনে যেখানে পান থেকে চুন খসলেই ফাসির আদেশ হয়ে যায়, আজ যদি মওদুদি পাকিস্তানে বেচে থাকত তাকে কি রসুলুল্লাহ(সা:)এর সহীহ হাদিস অবমাননা করার কারনে ফাসি দেয়া হত না? অথচ আজ এই মওদুদিবাদিরাই তাদের প্রতিপক্ষকে নাস্তিক মুরতাদ অমুসলিম এসমস্ত বলে প্রচার করে ভয়াবহ নাশকতা করে যাচ্ছে আর তার সাথে সুর মিলাচ্ছে তাদের মিথ্যা ও প্রতারনার ফাদে পা দেয়া কিছু ধর্মিয় দল। ইসলাম ত্যাগ করার কারনে যদি কাউকে শাস্তি পেতে হয় তাহলে মওদুদিবাদিদেরই সবার আগে পেতে হবে। উপমহাদেশের কয়েকজন আলেমের জামাত সম্বন্ধে বিভিন্ন সময়ে তাদের দেয়া অভিমত নীচে তুলে ধরা হলো। এগুলো পর্যালোচনা করলে সহজে বোঝা যাবে কি কারনে ১৯৭১ সালে ধর্মের ছদ্মাবরনে তারা নিজের জাতির উপর পৈশাচিক বর্বরতা চালিয়েছিল, সত্যিকারের একটি ইসলামি দলের পক্ষে যা করা সম্ভব নয়। কি কারনে অন্যান্য ইসলামি দলগুলো তাদের সাথে জোট বাধে সেটাই আশ্চর্যের ব্যাপার। তাদের সাথে জোট বেধে ক্ষমতায় গেলে শুধু জামাতই বিনপির পরে একচেটিয়া সব সুফল ভোগ করে সে বিষয়ে ইসলামি দলগুলোর একদিন হয়ত বোধোদয় হবে।
দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান মুফতি মাওলানা সাইয়েদ মাহদি হাসান এক ফতোয়ায় বলেছিলেন: “মুসলমানদের জামাতের আন্দোলনে অংশ নেয়া মোটেও উচিত নয়। এটা তাদের জন্য জীবন ধংসকারি। শরিয়ার দৃষ্টিতে এই দলে যোগ দেয়া থেকে মানুষজনকে বিরত করা দরকার। এই দল মানুষের ভালোর চেয়ে ক্ষতিই বেশি করে। যারা এই দলের লক্ষ ও আদর্শের জন্য কাজ করে তারা পূন্যের বদলে পাপ কামাবে। সে নিজেকে এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে পারবে না ও অন্যদের পাপের দিকে ধাবিত করবে। যদি কোন মসজিদের ইমাম জামাতে মওদুদির সদস্য হোন, তার পেছনে নামাজ পড়া মাকরুহ।” সাংঘাতিক দারুন ফতোয়া
তাবলিগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াসের ছেলে ও তার উত্তরসূরী মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফ বলেছেন: “জামাতে মওদুদি হলো ক্ষমতালোভী একটি রাজনৈতিক দল। তারা এমন সব জিনিস গ্রহন করেছে যেগুলো শরীয়ার দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ।”
প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস মাওলানা জাকারিয়া (তাবলিগ জামাতের তালিমে বহুল ব্যবহ্রত ফাজায়েলে আমাল বইয়ের লেখক) বহু তথ্য সমৃদ্ধ ফিতনায়ে মওদুদিয়াত নামে জামাতের উপর একটি বই লিখেছেন। সেখানে তিনি জামাতে মওদুদির কোরান ও হাদিসের আলোকে ইসলাম বিরুদ্ধ বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন। বইটির এক জায়গায় তিনি মন্তব্য করেছেন: “আমি এই দলে যোগ দেয়া হারাম মনে করি। তাদের পুস্তক পাঠ করা মুসলমানদের জন্য খুবই ক্ষতিকর।”
দেওবন্দ থেকে আরেকটি ফতোয়াতে বলা হয়েছে: “জামাতের বই-পুস্তক সাহাবা ও ইমাম-মুজতাহিদের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক বিনষ্টকারি। মওদুদির ভ্রান্ত মতবাদের বই-পুস্তকের উপর ভিত্তি করে জামাতের আন্দোলন একারনে অবশ্যই মুসলমানদের জন্য ক্ষতিকর। আমরা এদের সাথে পুরোপুরি সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষনা দিচ্ছি।”
লালবাগ জামিয়া কোরানিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরি “ভুল সংশোধন” নামক একটি বইয়ে দেশবাসিকে জামাতে মওদুদির ইসলাম বিরোধি মতাদর্শ ও চিন্তাধারার ব্যাপারে সাবধান হতে বলেছেন। এক জায়গায় তিনি বলেছেন তার সারমর্ম হলো: “কোন মুসলমানের জন্য জামাতে যোগ দেয়া ও এই দলের জন্য কাজ করা উচিত নয়। যারা সাহাবাদের ভুলত্রুটি অন্বেষনে ব্যস্ত থাকে তাদের ইমাম বানানো উচিত হবে না কেননা এই ইমামদের পিছনে নামাজ গ্রহনযোগ্য নয়। সাহাবাদের ভুলত্রুটি অন্বেষনকারিদের আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতে কোন অংশিদারি নেই।”
খেলাফত আন্দোলনের হাফেজজি হুজুর, এমনকি জামাতের জোটের মিত্র মুফতি আমিনী ও শায়খুল হাদিস আজিজুল হক জনসাধারনকে অতিতে বহুবার জামাতের অশুভ প্রভাবের ব্যপারে সচেতন থাকতে বলেছিলেন।