৫ই মে শাপলা চত্বর - বিনপি, জামাত ও হেফাজত ৩,০০০ মৃত সংখ্যাটি কিভাবে পেল?
মাঝে মাঝে মনে হয় অদ্ভূত আমাদের এই বাংলাদেশ। এই দেশে অনেক সত্য যেমন আছে আবার তেমনি তার সাথে পাল্লা দিয়ে মিথ্যাও সমান তালে চলে। ভালো খারাপ কোন কিছু ঘটার সাথে সাথে আমরা দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ি। তার সাথে যদি যোগ হয় আমাদের প্রিয় দলের কোন নেতার বক্তব্য তাহলে ত কথাই নেই, সেটা যত মিথ্যাই হোক তাকে মহাসত্যে রুপ দেয়া আমরা গুরু দায়িত্বের মধ্যে গন্য করে ফেলি। দেশের একটি বড় অংশের কাছে গুজব খুব একটি প্রিয় জিনিস। গুজব ছাড়া তাদের দিন যেন চলতেই চায় না। আর গুজব যদি হয় আমাদের অপ্রিয় দলটিকে নিয়ে তাহলে ত কথাই নেই। এটিকে ডালপালা মেলে যত দ্রত যত মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেয়া যায় তাহলেই পরম শান্তি।
সাভারে মনুষ্যসৃষ্ট ভয়াবহ ট্র্যাজেডির রেশ সামান্যতমও কাটে নি তার মধ্যে জোর করে মানবতার দাবি তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে হেফাজতে ইসলাম তাদের ৫ই মে'র অবরোধ কর্মসূচী পালন করল। অনেক সংগঠন তাদের কর্মসূচী স্থগিত করল, কিন্তু হেফাজত শত অনুরোধ প্রত্যাখান করল। এতে মানুষের মধ্যে তাদের প্রতি একটা অশ্রদ্ধার জন্ম নিল কিনা তারা খোজ নিয়ে দেখতে পারেন। কয়েকদিন পিছিয়ে দিলে তাদের মনে হয় মহাক্ষতি হয়ে যেত। তাদের সজ্ঞা অনুযায়ি যারা নাস্তিক তাদের ফাসি দেওয়াটা তখন মারাত্মক জরুরি হয়ে পড়েছিল। যুদ্ধাপরাধিদের দল জামাতের ফাদে পড়লে ইহকাল পরকাল দুটোই মাটি হয়ে যেতে পারে হেফাজতকে তাদের পরবর্তি কর্মসুচীর আগে একটি বার হলেও তা ভেবে দেখার সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছি। বিনপি সাভার ট্র্যাজেডির প্রতি সম্মান দেখিয়ে যেখানে নিজেদের পূর্ব ঘোষিত হরতাল প্রত্যাহার করল, তারাই আবার হেফাজতের কর্মসূচীকে পুর্ণ সমর্থন দিয়ে যা করল তা কি জনগনের সাথে প্রতারনা নয়? হেফাজতের কর্মসুচীর ভেতর বিনপি জামাতের সরকার উৎখাতের একটি গোপন পরিকল্পনা ছিল বলেই মনে হয়। দিনভর অবিশ্বাস্য ও ভয়াবহ তান্ডবের পর হেফাজত যখন হঠাৎ করে মতিঝিলে অবস্থান কর্মসূচী ঘোষনা করে বসে তখন আপামর জনসাধারন আতংকিত হয়ে পড়ল। দেশের অর্থনীতির কেন্দ্রস্থল থেকে এদের উচ্ছেদ করা ছাড়া সরকারের আর কোন উপায় ছিল না। নিরাপত্তা বাহিনীদের যৌথ অভিযানে এত অল্প সময়ে হেফাজতিরা যে পালিয়ে যাবে তা ছিল সবার ধারনাতিত। যারা মরলে শহীদ বাচলে গাজী মন্ত্রে দীক্ষিত, শহীদ হওয়ার জন্য একপায়ে খাড়া, শহীদ হওয়াকে পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার মনে করে তারা যে এভাবে বিনপি-জামাতের মনে নিদারুন কষ্ট দিয়ে রনে ভঙ্গ দিবে তা ছিল কল্পনার বাইরে। তবে পুরো দেশবাসির সাথে প্রবাসিরাও হাফ ছেড়ে বাচল।
এই সরকারের অনেক অযোগ্যতা, ব্যর্থতার মধ্যে এই অপারেশন শাপলা চত্বরটি দারুন সফল অভিযান। যার অনুমতি ছাড়া একটি পাতা পর্যন্ত নড়ে না তাকে আল্লাহ খোদা ইশ্বর বিধাতা যে নামেই ডাকি না কেন, তিনি একটি পক্ষকে বিশেষ অনুগ্রহ দেখিয়েছিলেন সে রাতে। কিন্তু এই সফল অপারেশনে বিরোধিদল যে ভীষন নাখোশ তাদের বড় বড় নেতাদের বক্তব্যগুলো তা প্রমান করছে। এমকে আনোয়ার বললেন এই অপারেশনে সরকার ২,৫০০ হেফাজতিকে গনহত্যা করেছে। পরেরদিন সাদেক হোসেন খোকা আরো এক কাঠি বাড়িয়ে বললেন ৩,০০০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি নাকি বিবিসি ও সিএনএন পড়ে জেনেছেন এই সংখ্যাটি। প্রথম আলোর প্রথম পাতার খবরে রিপোর্টার লিখলেন তিনি তন্ন তন্ন করে বিবিসি ও সিএনএন এ সংখ্যাটি খুজে পান নি। বিবিসে নিউজে বলছে ২৭ জন মারা গেছে ৫ ও ৬ই মে দুইদিনে সারা দেশ জুড়ে। বাংলাদেশ ইসলামিস্ট ব্যাটল পুলিশ শিরোনামে সিএনএন রিপোর্টে বলছে ৪ জন মারা গেছে।
কালের কন্ঠের ১৬ই মে'র অনুসন্ধানী রিপোর্টে কাউকে নিখোজঁ খুজে পাওয়া যায়নি। হেফাজতের দাবিকৃত মৃত ছাত্র চাদঁপুরে ক্লাস করছে - একইদিনের ইত্তেফাকের খবর। কালের কন্ঠের ১৮ই মে'র "নিখোঁজের কোনো প্রমান খুজেঁ পাচ্ছে না হেফাজত" শিরোনামের রিপোর্টে বলছে ৩,০০০ নিখোঁজ প্রমানে মাদ্রাসায় মাদ্রাসায় অনুসন্ধান চালিয়ে সাত দিনে একজনকেও নিখোঁজ পায়নি সংগঠনটি। এছাড়া ১৭ই মে'র প্রথম আলোর খোলা কলমে লেখা "নূরে আলমের জন্য শুভকামনা" শিরোনামে লেখাটিও বিনপি জামাত ও হেফাজতিদের দাবির সত্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। হিউমেন রাইটস ওয়াচ বলছে বিরোধিদলের গনহত্যার দাবি পুরোপুরি ভিত্তিহীন। তাদের মতে ৫০ জনের মত মৃত হতে পারে। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের মে'র ৮তারিখ “শাপলা চত্বর এন্ড এক্ট অব হুডিনি” শিরোনামে প্রথম পাতার আর্টিকেলে রিপোর্টার জোরালো যুক্তির মাধ্যমে দেখিয়েছেন কেন এত অল্প সময়ের মধ্যে ৩,০০০ মানুষকে মেরে একেবারে গায়েব করে দেয়া সম্ভব নয়।
তবে আমার যেটি ধারনা তা হলো বিরোধিদলগুলোর ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত দেশে বা প্রবাসে কম্পিউটার পারদর্শি (উদাহরন হিসেবে শিবির ক্যাডারদের বাশের কেল্লার কথা মনে করুন) এমন কেউ সিএনএন আইরিপোর্টে একাউন্ট খুলে বাংলাদেশে ২,৫০০ থেকে ৩,০০০ লোককে গনহত্যা করা হয়েছে বলে বেশ কিছু জালিয়াতি লেখা পোস্ট করে দিয়েছে। সিএনএন আইরিপোর্টে যে কেউ একাউন্ট খুলে যা তা লিখতে পারে। এগুলো সিএনএন এর সাংবাদিকদের বানানো বস্তুনীষ্ঠ রিপোর্ট নয়। স্রেফ ব্লগের মত। এদের প্রতিটির সাথে "নট ভেটেড বাই সিএনএন" (সত্যতা পরীক্ষা করা হয়নি) ট্যাগ লাগানো থাকে যা পাঠককে স্মরন করিয়ে দেয়ার জন্য যে এগুলো সিএনএন এর সাথে যুক্ত নয় এমন কিছুলোকের ব্যক্তিগত লেখা। এমনকি এই ব্লগগুলোর নীচে যে বাংলাদেশিরা কমেন্ট লিখছেন তাদেরও অনেকে মনে করছেন এগুলো সিএনএন এর রিপোর্টারদের করা খাটি রিপোর্ট। এখন বিরোধিদলের বড় বড় নেতারা যদি এগুলোকেই বলে সিএনএন থেকে প্রাপ্ত তথ্য, তাহলে সেটি হবে ভীষন লজ্জার। তারা ধরে নিয়েছেন যে দেশের মানুষ খুব অজ্ঞ, এটা ধরা তাদের জন্য কঠীন। তাদেরও পুরো দোষ দেয়া যায় না, যা তা গেলার জন্য দলকানা বহু লোক আছে। আর সরকারও এত দুর্বল আর অকর্মন্য যে বিরোধিদলগুলোর মিথ্যা প্রচারনার যুতসই জবাব দিতে পারছে না। শিবিরের কিছু কম্পিউটারভিত্তিক ক্যাডারের মিথ্যা প্রপাগান্ডার কাছে সরকার হেরে যাচ্ছে বারবার। মজার ব্যাপার হলো যারা গনহত্যা হয়েছে বলে দাবি তুলছে তারা কোন জোরালো প্রমান দেখাতে দেখাতে পারছে না। তাই তারা বিভিন্ন ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছে। তারা ২০১০ সালে হাইতির ভূমিকম্পে নিহতদের সারিবদ্ধ লাশের ছবি শাপলা চত্বরের বলে চালিয়ে দিচ্ছে। এমনকি ১৯৭৮ সালের সংঘটিত জোনসটাউনে শয়ে শয়ে গন আত্মহত্যাকারিদের লাশের ছবিও একাজে ব্যবহার করেছে।
যারা গনহত্যা হয়েছে দাবি করছে তারা খুব সরল একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে না। সাভারে হাজারের উপর মৃতের জন্য যত লোক জড়ো হয়েছিল এতদিন ধরে, সে হিসেবে ৩,০০০ হেফাজতির লাশ যদি সরকার গুম করে থাকে তাহলে কত হাজার লোকের মৃত আত্মিয়ের খোজে হন্যে হয়ে খোজার কথা? কেউ একজনও কেন এতদিনে এগিয়ে এল না নিখোঁজ আত্মিয়ের খোজে? সরকার থেকে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ৩,০০০ মৃত ব্যক্তির নাম ঠিকানার লিস্ট জমা দিতে বিরোধিদলের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হয়েছে। সেই ৪৮ ঘন্টা অনেক আগে পেরিয়ে গেছে। লিস্টের নামগন্ধটি নেই। তবে নানাজন নানাধরনের যুক্তি দেখাচ্ছে তাদের নেতাদের দাবি অনুযায়ি গনহত্যা হয়েছে তা প্রতিষ্ঠা করার জন্য। মৃত ৩,০০০ সবাই নাকি এতিম ছিল সেজন্যেই নাকি কেউ এগিয়ে আসছে না। তারা এমনই এতিম তাদের ১৪ গুষ্ঠিতে কেউ নেই, মামা চাচা খালা ফুফু কেউ নেই! তাদের একজনেরও কোন একটি গ্রামে ঠিকানা পর্যন্ত নেই! যদি তা সামান্যতম সত্যি হয়, তাহলে কি দাড়াল যে এরকম সব অসহায় এতিমদের দিয়ে হেফাজত চলে? এই অসহায় এতিমদেরকে বিনপি, জামাত, হেফাজত জঘন্যভাবে ধোকা দিয়ে নিজেদের ফায়দা হাসিল করতে চেয়েছিল? এটি কি এক ধরনের অপরাধ নয়?
বলা হচ্ছে হেফাজতের ৩,০০০ নেতা ও কর্মি মারা গেছেন। কর্মিদের বাদ দিলাম, তাদের কোন নেতাটি মারা গেছেন তা আমাদের বলবেন কি? জনগন জানে হেফাজতি নেতারা কোথায় ছিলেন ৫ই মে'র রাতে। তারা অভিযানের খবর পেয়েই হোক অথবা আরাম আয়েশে খাওয়া দাওয়া ঘুমের জন্যই হোক, মতিঝিলে অবস্থান ঘোষনা দিয়ে নীরিহ শিশু কিশোরদের একা ফেলে পালিয়ে চলে গিয়েছিলেন। যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে গেলে পরকালে মুসলমানের কি শাস্তি কওমি হুজুররা সেই সহীহ হাদিসটি কি জানেন না? বলা হচ্ছে সরকার কেন সব বাতি নিভিয়ে অন্ধকার করে ফেলল। ভয় দেখানো বা আতংকিত করার জন্য এটি একটি কৌশল হতে পারে। সেটা যে দারুন কাজে লেগেছে ফলাফলই তা প্রমান করে।
হেফাজতের এক কথা ইসলামের অবমাননা বন্ধ করতে হবে (রাজাকারদের বিচার চাওয়াও যে তাদের কাছে ইসলাম অবমাননার সামিল সেটা মুখ ফুটে বলতে তাদের শরম লাগে)। তারা যে ভয়াবহ তান্ডব চালিয়ে কোরান শরিফ পুরিয়ে অসংখ্য গরীব মানুষের সর্বনাশ করে পবিত্র ইসলাম ধর্মের চরম অবমাননা নিজেরাই করল সে সামান্য জিনিসটা বোঝার ক্ষমতা কি তাদের আছে? কোন মুসলমান যদি তাদের এই জঘন্য কুকর্ম দেখে ধর্ম থেকে দুরে সরে যায় তার জন্য যে তাদের পরকালে রোজ হাশরের ময়দানে আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে হবে সেটা কি তারা জানে না? দৈনিক আমার দেশের কাবা শরিফের গিলাফ পরিবর্তনের ছবি জালিয়াতি করে মিথ্যা খবর প্রকাশ করা কি ধর্মের অবমাননা নয়? কিংবা ওআইসির সেক্রেটারি জেনারেলের বিবৃতিকে সম্পূর্ন বিকৃত করে হেফাজতিদের আরেক পত্রিকা দৈনিক নয়া দিগন্তের মার্চের ৮ তারিখে "বিতর্কিত ট্রাইবুনাল বাতিল করুন" শিরোনামে ভুয়া খবর প্রকাশ করা কি কোন ধর্মপ্রান মুসলমানের কাজ? যারা বা যে দলের লোকজন সাঈদীর ছবি ফটোশপের মাধ্যমে জালিয়াতি করে তাকে চাদে দেখা গেছে বলে উসকানিমূলক প্রচারনা করে বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভয়াবহ দাঙ্গা লাগালো, এ সম্বন্ধে হেফাজতের বক্তব্য কি? এব্যাপারে অনেকে সোচ্চার হলেও রহস্যজনক কারনে হেফাজতিরা সম্পূর্ন নীরব। অথচ এটি ছিল এক ধরনের কুফরি ও ধর্মের চুড়ান্ত অবমাননা। ইসলাম ধর্মের অবমাননা করার কারনে এদের ফাসির দাবি কেন হেফাজতিরা করছে না?
দুটি বিষয়ের অবতারনা করে লেখাটি শেষ করতে চাই। ২৭, ৫০ নাকি ৩,০০০ এর মত মারা গিয়েছিল সেদিন এই সংখ্যা বিতর্কের বাইরে যেয়ে কেউ আলোচনা করছে না যে একজন হেফাজতির কাছে শহীদ হওয়া পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। তারা সবাই সেদিন শহীদ হওয়ার নিয়তে জেহাদি জোশে সরকার পতনের লক্ষে ঢাকা দখল করতে এসেছিল। তাদের ভাষ্যমতে যে ৩,০০০ নিহত হয়েছে, তাদের জীবন ধন্য ও স্বার্থক। আরেকটি ব্যাপার এখানে ভেবে দেখার তা হলো আল্লাহ না করুক হেফাজতিরা যদি সেদিন সরকার পতনে সফল হয়ে নিজেরা সরকার গঠন করত, আজকে নতুন আরেকটি তালেবান রাষ্ট্রের সূচনা হত বিশ্বের বুকে। তখন দৈনিক না হোক, সপ্তাহ বা মাসে তিন চার হাজার লোক গ্রেনেড বোমায় উড়ে যেয়ে বা গুলি খেয়ে মরে যাওয়া একটি নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিনত হত। বাংলাদেশ আরেকটি পাকিস্তান বা আফগানিস্তানে পরিনত হোক আমরা কেউ ভয়ংকর দুঃস্বপ্নেও তা কামনা করি না।