২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর সহিংসতার তদন্ত প্রতিবেদন। দায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্বল প্রশাসন ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ
ওটা ছিল ‘মানবিক দুর্যোগ’
অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনোত্তর সহিংসতাকে ‘মানবিক দুর্যোগ’ উল্লেখ করে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ধরনের সহিংস ঘটনার জন্য ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্বল প্রশাসন এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দায়ী।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দলীয় আনুগত্যের কারণে সে সময়কার তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্যাতন বন্ধ করতে প্রশাসনিকভাবে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারেনি। আবার জনগণের কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো জবাবদিহি না থাকায় খেয়ালখুশিমতো প্রশাসন চালিয়েছে। বিশেষ করে, ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রশাসনে রদবদলের মাধ্যমে সহিংস ঘটনার জন্য পথ সৃষ্টি করে গেছেন।
উল্লেখ্য, ওই সময় প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন লতিফুর রহমান। যোগাযোগ করা হলে ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ‘তখন আমাদের কাছে যেসব অভিযোগ এসেছিল, সেগুলোর ব্যাপারে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।’ তদন্ত প্রতিবেদনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্বল প্রশাসনকে দায়ী করার বিষয়টি ঠিক নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনটি দুর্বল।
২০০১ সালের ১ অক্টোবরের সাধারণ নির্বাচনের পরপরই দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংস ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর একের পর এক হামলা হতে থাকে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, হাত-পা কেটে নেওয়া এবং খুন-ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিশন গতকাল প্রতিবেদন পেশ করেছে।
প্রসঙ্গত, এ ধরনের নৃশংস ঘটনার কারণ উদ্ঘাটন এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে ‘হিউম্যান রাইট ফর পিস’ নামের একটি মানবাধিকার সংগঠন হাইকোর্টে রিট আবেদন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ৬ মে এসব নির্যাতনের অভিযোগ তদন্তের জন্য সরকারকে নির্দেশ দেন আদালত। এরপর ২০১০ সালের ২৭ ডিসেম্বর অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ মুহাম্মদ সাহাবুদ্দিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের দুই সদস্য হলেন উপসচিব মনোয়ার হোসেন আখন্দ ও ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মীর শহিদুল ইসলাম।
জানা গেছে, গত বছরের ফেব্রুয়ারি ও মার্চে হত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন সহিংস ঘটনায় পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ওই গণবিজ্ঞপ্তি জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও ডিআইজিদের কাছে পাঠানো হয়। তদন্ত কমিশন মাঠপর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছ থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
গতকাল রোববার বেলা দেড়টায় তিন সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের সদস্য মনোয়ার হোসেন আখন্দ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। কমিশন গঠনের প্রায় এক বছর পর প্রতিবেদন জমা দেওয়া হলো। তবে প্রতিবেদনে কী আছে, সে বিষয়ে সাংবাদিকদের কাছে কোনো মন্তব্য করেননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা কমিটির সদস্যরা।
তদন্ত কমিশনের সুপারিশে ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর ঘটনার জন্য দায়ী অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে দ্রুত মামলা করারও সুপারিশ করা হয়েছে।
জানতে চাইলে কমিশনের সদস্য মনোয়ার হোসেন আখন্দ প্রথম আলোকে বলেন, ওই সময়ের সহিংস ঘটনাগুলো একেকটি ‘মানবিক দুর্যোগ’। এ দুর্যোগের ধারা থেকে বের হয়ে প্রশাসন দলীয়করণমুক্ত হবে—এটাই কমিশনের প্রত্যাশা। তিনি বলেন, ২০০১ সালের নির্বাচনের পরপরই যেসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, তার সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতিহিংসার কারণেই এসব ঘটনা ঘটেছে।
তদন্ত প্রতিবেদন: সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পাঁচ খণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদনটি এক হাজার ৭৮ পৃষ্ঠার। তদন্তকালে কমিশন মোট অভিযোগ পেয়েছে পাঁচ হাজার ৫৭১টি। ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে ২০০২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাওয়া অভিযোগের সংখ্যা তিন হাজার ৬২৫। এর মধ্যে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ৩৫৫টি এবং লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, পঙ্গুত্ব, গুরুতর আঘাত, সম্পত্তি দখল ও অন্যান্য গুরুতর অভিযোগ তিন হাজার ২৭০টি। অভিযোগ বাতিল করা হয়েছে এক হাজার ৯৪৬টি। কমিশনের তদন্ত করা তিন হাজার ৬২৫টি ঘটনায় ১৮ হাজারেরও বেশি লোক জড়িত। কমিশনের প্রতিবেদনে সহিংস ঘটনার কিছু উদাহরণ, কারণ ও পটভূমি, সহিংসতার ধরন, সারসংক্ষেপ, প্রাসঙ্গিক মতামত ও সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে ভোলা, বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ঢাকা বিভাগের বিবরণ আলাদাভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ২০০১ সালের নির্বাচনের পরপরই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও সাধারণ মানুষের ওপর সহিংস ঘটনার ব্যাপারে তদন্ত কমিশন প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এটি শিগগিরই প্রকাশ করা হবে। তদন্ত কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী দোষী ব্যক্তিদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। সহিংস ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা যদি এখন মামলা করতে চান, সরকার তাঁদের সহযোগিতা করবে। তিনি বলেন, পুরো প্রতিবেদনটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো যাবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে ব্যাপক সহিংস ঘটনা ঘটায়। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের খুন করে। সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও বসতবাড়ি উচ্ছেদ, জমি দখল করে। নারী ধর্ষণসহ অবর্ণনীয় নির্যাতন-নিপীড়ন চালায়। সংখ্যালঘুদের এ দেশ থেকে বিতাড়িত করতে যা করা দরকার, তা-ই তারা করেছিল।
চিহ্নিত দায়ী ব্যক্তি: প্রতিবেদনে কিছু রাজনৈতিক নেতাকেও দায়ী করা হয়েছে। তাঁরা হলেন জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষনেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, হাফিজউদ্দিন আহমেদ, তরিকুল ইসলাম, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, আবদুস সালাম পিন্টু, জয়নাল আবেদীন, আবদুল হাফিজ, এম এ এইচ সেলিম ও হাফিজ ইব্রাহিম। সূত্রমতে, তদন্ত প্রতিবেদনে এমন আরও কয়েকজনের নাম রয়েছে।
কারণ ও পরিপ্রেক্ষিত: বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় নেতা-কর্মীদের পাঁচ হাজার ৮৯০টি মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে উল্লেখ করে তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। রাজনৈতিক আক্রোশের কারণে কারও হাত-পা কেটে ফেলা হয়, কারও চোখ তুলে ফেলা হয়, অনেক নারীকে ধর্ষণ করা হয় মায়ের সামনেই।
কমিশন জানায়, ২০০১ সালে নির্বাচনোত্তর সহিংসতার ঘটনায় যেসব ব্যক্তির ওপর আক্রমণ করা হয়েছিল, লুটপাট চালানো হয়েছিল, গণধর্ষণ করা হয়েছিল, তাঁরা থানায় বা আদালতে অভিযোগ দায়ের পর্যন্ত করতে পারেননি। আবার কেউ কেউ অভিযোগ করতে পারলেও রাজনৈতিক কারণে তদন্ত করা হয়নি।
সুপারিশ: কোনো মামলা হয়ে থাকলে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করার জন্য প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপক্ষ এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সহায়তা করবে। অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে রয়েছে—এ ধরনের সহিংস ঘটনা তদারকি করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি সেল গঠন করা, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের আর্থিক সহায়তা করা, রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণে পরিবর্তন আনা, নির্বাচনে জয়লাভের পর পরাজিতদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব, জয়লাভের পর তাৎক্ষণিক বিজয়োল্লাস পরিহার করা, জনগণের রায়কে স্বীকৃতি দেওয়া, স্থানীয় প্রশাসনকে দলীয়করণ ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা, এসব ঘটনা তদন্তের জন্য প্রতি জেলায় একটি করে স্বল্পমেয়াদি কমিটি বা কমিশন গঠন করা ইত্যাদি।