যুক্তরাষ্ট্রে তদবিরকারী প্রতিষ্ঠান নিয়োগ
মীর কাসেমকে সাহায্য করেন বিএনপির নেতা
বিএনপির ওই প্রবাসী নেতার নাম শরাফত হোসেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সহসভাপতি এবং তদবিরকারী প্রতিষ্ঠান ক্যাসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটের সদস্য (টিম মেম্বার)। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে আড়াই কোটি ডলারের চুক্তি করেন মীর কাসেম আলী।
বাংলাদেশ ব্যাংক এই অর্থ লেনদেন নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাও মীর কাসেম আলীর অর্থ পাচারের বিষয়টি অনুসন্ধান করছে।
চুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রবাসী শরাফত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্যাসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটে কাজ করি—যদি তা আপনি জানেন, তবে তা লিখতে বা বলতে পারেন। কিন্তু এ ব্যাপারে টেলিফোনে আমি কোনো কথা বলব না।’
গত তিন মাসে কয়েক দফা যোগাযোগ করার পরও মীর কাসেম আলী এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সরকারি সূত্র নিশ্চিত করেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ঠেকাতে ওয়াশিংটনে লবিস্ট নিয়োগ করেছিলেন মীর কাসেম আলী। চুক্তির পর গত বছরের ৬ অক্টোবর মীর কাসেম আলীকে লেখা এক চিঠিতে ক্যাসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটের আন্তর্জাতিক কার্যক্রমবিষয়ক নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট আমোস জে হোচেস্টাইন জানান, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ে তাঁরা তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব চিঠির অনুলিপি সরকারের হাতে রয়েছে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, ছয় মাসের জন্য কাজ করবে—এই শর্তে ক্যাসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটের সঙ্গে মীর কাসেম আলী ২৫ মিলিয়ন বা আড়াই কোটি মার্কিন ডলারের একটি চুক্তি করেন। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ১৮২ কোটি টাকা। এই অর্থ পরিশোধও করা হয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক ফোরামের নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাসেম আলী বর্তমানে দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান। এ ছাড়া তিনি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক, ইবনে সিনা ট্রাস্টের সদস্য (প্রশাসন) এবং কেয়ারি হাউজিং ও ইডেন শিপিং লাইনসের চেয়ারম্যান। তিনি রাবেতা আলম আল ইসলামীর এদেশীয় পরিচালক। ১৯৭১ সালে ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন মীর কাসেম আলী। মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার ব্যাপারে তাঁর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তদন্ত করছে। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মীর কাসেমের বিরুদ্ধে সংস্থা তদন্ত করছে। সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
চুক্তিতে যা বলা হয়েছে: চুক্তির শর্তে বলা হয়েছে, ক্যাসিডি তাঁর (ক্লায়েন্ট) পক্ষে মার্কিন সরকার, কংগ্রেস ও সিনেট সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করবে। এ ছাড়া মার্কিন বৈদেশিক নীতি, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার বিষয়গুলো যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করেন এবং মার্কিন প্রশাসনের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করবে।
২০১০ সালের ১০ মে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। ক্যাসিডির পক্ষে চুক্তিতে সই করেন প্রতিষ্ঠানের জেনারেল কনসাল অ্যান্ড্রু জে ক্যামেরস। আর মীর কাসেম আলী চুক্তিতে ‘মীর আলী’ নাম দিয়ে সই করেছেন। এ চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে গত ৫ এপ্রিল।
ক্যাসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট: ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কংগ্রেসম্যান মার্টি রুশো। প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা হচ্ছে—৭০০ থার্টিন্থ, এনডব্লিউ, সুইট-৪০০, ওয়াশিংটন ডিসি।
২০০৯ সালের ২১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ব্যবসাবিষয়ক ডেইলি দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এক পাতাজুড়ে প্রেসিডেন্ট ওবামার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করে। (আগের দিন, ২০ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন ওবামা।) ওই তালিকায় ক্যাসিডির প্রতিষ্ঠাতা, বর্তমান নির্বাহী চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জেরাল্ড এস জে ক্যাসিডির নামও রয়েছে। একটি মার্কিন পত্রিকায় একে ৩৫ বছর ধরে সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠাকারী সবচেয়ে শক্তিশালী ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ করে জেরাল্ড এস জে ক্যাসিডিকে এর ‘মাস্টার বিল্ডার’ বলা হয়েছে।
চুক্তির বিষয়ে কথা বলতে নিউইয়র্ক ও ঢাকা থেকে বারবার ওয়াশিংটনের ক্যাসিডি অফিসে ফোন করা হলেও কেউ কথা বলেননি। ই-মেইলে ক্যাসিডির সংবাদমাধ্যমের (মিডিয়া অ্যান্ড প্রেস রিলেশন) গ্রেগ ম্যাককার্থির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
চুক্তির পেছনে বিএনপির নেতা: শরাফত হোসেন বিএনপির যুক্তরাষ্ট্র শাখার সভাপতি হতে চান। খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় শরাফত হোসেনকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর পাশে দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিনি নিজেকে খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ জুবাইদা রহমানের আত্মীয় বলে পরিচয় দেন। খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক সফরের সময় শরাফত হোসেন তদবিরের কাজে দুই লাখ ডলার ব্যয় করেও উচ্চপর্যায়ের মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কোনো বৈঠকের ব্যবস্থা করতে পারেননি। এ ব্যাপারে শরাফত হোসেন বলেন, ‘দলের নেত্রীর লবিংয়ের সঙ্গে আমার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে কিছু বলতে চাই না।’ তবে খালেদা জিয়ার যুক্তরাষ্ট্র সফরের অনেক অর্থ এখনো পড়ে আছে বলে তিনি জানান।
ক্যাসিডির ওয়েবসাইটে শরাফত হোসেনের ছবিসহ পরিচিতিতে বলা আছে, তিনি সিনিয়র কনসালট্যান্ট, বিজনেস ডেভেলপমেন্ট। তাঁর প্রধান কাজ উপযুক্ত ব্যক্তি (পোটেনশিয়াল কাস্টমার) খুঁজে বের করা এবং বিদেশি ব্যবসা সম্পর্কে অবহিত করা। ঢাকায় অনুসন্ধানকারী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধারণা, ক্যাসিডির সঙ্গে মীর কাসেম আলীর যোগাযোগটা শরাফত হোসেনের মাধ্যমে হয়ে থাকতে পারে।
অর্থ পাচারের অভিযোগ: শর্তানুযায়ী চুক্তির পরে আড়াই কোটি ডলার অগ্রিম পরিশোধ করতে হয়েছে মীর কাসেম আলীকে। সিটিব্যাংক এনএর মাধ্যমে ইলেকট্রনিক ট্রান্সফার-পদ্ধতিতে চুক্তির অর্থ ক্যাসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটের হিসাব নম্বরে (৩০৭১৭২৪৮, সুইফট কোড: সিটি ইউএস ৩৩) পাঠানো হয়। এই অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাঠানো হয়েছে কি না, তা এখন অনুসন্ধান করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।