Monday, August 15, 2011

BNP's 2001 Post Election Violence Another Report

দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে সরকার



২০০১ নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার তদন্ত প্রতিবেদন পেশ
Daily Samakal      April 15, 2011






২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর সহিংস ঘটনা তদন্তে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গতকাল রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী সংখ্যালঘু ও সাধারণ মানুষের ওপর সহিংস ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে সরকার। তদন্ত কমিশনের সদস্য সচিব একেএম মনোয়ার হোসেন আখন্দ প্রতিবেদনটি জমা দেন। ঘটনার প্রায় সাড়ে ৯ বছর পর এবং কমিশন গঠনের প্রায় সোয়া এক বছর পর তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়ল।

পাঁচ খণ্ডের এ প্রতিবেদনে ৫ হাজার ৫৭১টি অভিযোগ স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে খুনের ঘটনা ৩৫৫টি. ধর্ষণ, লুটপাট, অগি্নসংযোগসহ গুরুতর অপরাধের ৩ হাজার ২৭০টি ঘটনা চিহ্নিত করা হয়েছে। আর এসব ঘটনা সংঘটিত হয়েছে ২০০১ থেকে ২০০২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে।

১ হাজার ৭৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন পাওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, সুপারিশ অনুযায়ী সরকার শিগগিরই এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেবে। প্রতিবেদনও জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে।

তদন্ত কমিশনের এক সদস্য এ প্রতিবেদকের কাছে প্রতিবেদনের দু'একটি ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার পরপরই নিজের গোয়ালের গরু জবাই করে মেজবান দেন যশোরের চৌগাছায় ভাদ্রা গ্রামের আবদুল বারিক। তার ছিল না কোনো রাজনৈতিক পরিচয়। তবে বঙ্গবন্ধু ও তার কন্যা শেখ হাসিনার একান্ত ভক্ত আবদুল বারিকের ওপর ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসায় নেমে আসে নিষ্ঠুরতা। বিএনপি ক্যাডাররা আবদুল বারিকের দুটি পা কেটে নেয় ও তার দুই ছেলেকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। আওয়ামী লীগের বিজয়ের আনন্দে গরু জবাই করে মেজবান খাওয়ানোয় তার ওপর এভাবে নির্যাতন করা হয়।

অন্যদিকে বাগেরহাটের ঘটনাটি আরও করুণ। বৃদ্ধ এক বাবার সামনে মেয়েকে গণধর্ষণ করে বিকৃত উল্লাসে মেতে ওঠে বিএনপি-জামায়াত ক্যাডাররা। ঘটনার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ভুক্তভোগীর পরিবার গেলেও কোনো বিচার পায়নি। উল্টো ক্যাডাররা তাদের দেশত্যাগের হুমকি দেয়। ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর সহিংসতার অনেক চিত্রই ছিল এমন।

সূত্র জানায়, ৫ খণ্ডের ওই প্রতিবেদনে লেখচিত্রসহ সহিংসতার ধরন ও প্রকার, সহিংস ঘটনার কিছু উদাহরণ, কারণ ও পটভূমি, সারসংক্ষেপ, প্রাসঙ্গিক মতামত ও সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। কমিশন প্রতিবেদনে সারাদেশে সংঘটিত ওইসব নির্যাতনের ঘটনায় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ কয়েক নেতার প্রত্যক্ষ মদদ রয়েছে বলে উলেল্গখ করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতিবেদন সম্পর্কে বলেন, ২০০১ সালে নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন, অত্যাচার, খুন, লুটপাট, ধর্ষণ, বাড়িতে অগি্নসংযোগ, হিন্দুদের ওপর নির্যাতন, বাড়িঘর দখলসহ নানা নৈরাজ্য চালিয়েছে।


তিনি আরও বলেন, অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী সংঘটিত সহিংস ঘটনার কারণ উদ্ঘাটন ও এর সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করার জন্য হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ ২০০৯ সালে উচ্চ আদালতে একটি রিট করে। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দেন।

তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে কি-না_ এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রতিবেদনটি আজ পাওয়া গেছে। এটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করার পর শিগগিরই জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে। অভিযুক্তদের বিচার করার বিষয়ে তিনি বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনায় রয়েছে দোষীদের বিচারের বিষয়ে উচ্চ আদালতের মতামত নেওয়া যেতে পারে। অভিযুক্তদের বিচারের জন্য সরকার উচ্চ আদালতের মতামত নেবে।

রিট মামলায় সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনার আলোকে সরকার গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ২০০৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর তিন সদস্যের একটি 'জুডিসিয়াল তদন্ত কমিশন' গঠন করে। কমিশনের প্রধান ছিলেন সাবেক জেলা ও দায়রা জজ মুহাম্মদ সাহাবুদ্দিন। অপর দুই সদস্য হলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব একেএম মনোয়ার হোসেন আকন্দ এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার মীর শহীদুল ইসলাম। ইতিমধ্যে কমিশনের মেয়াদ শেষ হলে ২৬ এপ্রিল ২০১১ পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করা হয়। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তদন্ত কাজ শুরু করে তদন্ত কমিশন। সচিব বলেন, প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ করা হয়, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রতিবেদন সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র সচিব আবদুস সোবহান শিকদার বলেন, প্রতিবেদনটি তৈরিতে কোনো বিষয় রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তাদেরই শনাক্ত করা হয়েছে।

প্রতিবেদন দাখিলের পর কমিটির সদস্য উপ-সচিব একেএম মনোয়ার হোসেন আকন্দ সাংবাদিকদের বলেন, ৫ খণ্ডের প্রতিবেদনের প্রথম খণ্ডে রিপোর্ট ও সুপারিশ পাতা সংখ্যা ১-১২১। দ্বিতীয় খণ্ডে ভোলা জেলার বিবরণ, পাতা ১ থেকে ২৭৫ পৃষ্ঠা। তৃতীয় খণ্ডে বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর জেলার বিবরণ, পাতা সংখ্যা ১-১৬৩। চতুর্থ খণ্ডে খুলনা বিভাগের বিবরণ, পাতা সংখ্যা ১-১৬৩। পঞ্চম খণ্ডে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও সিলেটের বিবরণ, পাতা ১-৩৫৬। মোট পাতার সংখ্যা ১ হাজার ৭৮টি। তিনি বলেন, ৫ হাজার ৫৭১টি ঘটনার মধ্যে ৩৫৫টি খুনের ঘটনা। ধর্ষণ, লুটপাট, অগি্নসংযোগসহ গুরুতর অপরাধের সংখ্যা ৩ হাজার ২৭০টি। আর এসব ঘটনা সংঘটিত হয়েছে ২০০১ থেকে ২০০২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে।

সূত্র জানায়, প্রতিবেদনে অভিযোগকারী, ঘটনার বিবরণ ও আসামিদের নাম-ঠিকানা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ছবি সংযুক্ত রয়েছে। এ প্রতিবেদন বাংলাদেশের বৃহত্তম তদন্ত প্রতিবেদন।

সূত্র জানায়, কমিশনের কাছে অভিযোগ জমা পড়ে ৫ হাজার ৫৭১টি। কমিশনের তদন্ত করা এসব ঘটনায় ১৮ হাজারেরও বেশি লোক জড়িত। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার পর হিন্দু সল্ফপ্রদায়ের ওপর নির্যাতনের অনেক ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হয়। হত্যা, ধর্ষণ, অগি্নসংযোগ, লুটপাটের এসব ঘটনার জন্য দায়ী করা হয় বিএনপি-জামায়াত জোটকে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবতী সহিংস নির্যাতনের ঘটনার বেশিরভাগ কমিশনের পক্ষে তদন্ত করা সম্ভব হয়নি। এসব ঘটনা তদন্তের জন্য কমিশন প্রতি জেলায় একটি করে স্বল্পমেয়াদি কমিটি বা কমিশন গঠন করতে সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে। কমিশনের তদন্তের ভিত্তিতে নতুন মামলা দায়ের, পুরনো মামলা পুনরুজ্জীবিত করা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা দিতেও সরকারকে সুপারিশ করা হয়েছে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী দলের শীর্ষ নেতার নির্দেশে দেশে কোনো সহিংস ঘটনা ঘটেনি উলেল্গখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, এভাবে দলগুলোর শীর্ষ নেতারা যদি সচেষ্ট থাকেন, তাহলে নির্বাচনোত্তর সহিংসতা বন্ধ করা সম্ভব।

বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনে ওই সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশাসনিক দুর্বলতার কথা উলেল্গখ করে বলা হয়েছে, নির্বাচিত না হওয়ায় এবং জনগণের কাছে জবাবদিহিতা না থাকায় তারা যা খুশি তাই করে থাকেন। অষ্টম সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে এটাই হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই নির্যাতনটা শুরু হয়। দলীয় আনুগত্যের কারণে ওই সরকার সংখ্যালঘু বা বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন প্রতিরোধ বা বন্ধ করতে প্রশাসনিকভাবে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

প্রশাসনিক রদবদলের মধ্য দিয়ে তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা ২০০১ সালে নির্যাতনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

এ তদন্ত কমিশন ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি সেন্ট্রাল সার্কিট হাউসে কার্যক্রম শুরু করে। একই বছরের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে সহিংস ঘটনা হত্যা, লুট, অগি্নসংযোগ, ধর্ষণ, বসতবাড়ি উচ্ছেদ, জমি দখল ইত্যাদি মানবতাবিরোধী অপরাধের তথ্য-উপাত্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সাক্ষ্য-প্রমাণ প্রদানের জন্য একটি 'গণবিজ্ঞপ্তি' পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করে। এরপর থেকেই কমিশন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিপুলসংখ্যক অভিযোগ ও আবেদনপত্র পেয়েছে।

এছাড়াও কমিশন তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহায়তার জন্য রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার সংগঠনের কাছে অনুরোধ করে চিঠি পাঠায়। কমিশনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সামাজিক ও মানবাধিকার সংগঠন ও সুধীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করে মতামত ও পরামর্শ গ্রহণ করে। এছাড়াও কমিশনে প্রাপ্ত অভিযোগ ও ঘটনার বিবরণ যাচাই-বাছাই করে কমিশনের সদস্যরা মাঠ পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সাক্ষ্যগ্রহণ ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ঘটনাস্থল সরেজমিন পরির্দশন করেন।