মন্তব্য প্রতিবেদন
দায় এড়াতে পারেন না বিএনপি-নেতৃত্ব
বিগত দুই দশকে বাংলাদেশের ভয়াবহ ঘটনাবলির মধ্যে সবচেয়ে নৃশংস ঘটনাটি ছিল ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। এই হামলায় জড়িত জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যরা বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলেই শনাক্ত হয়। সে সময়েই এ ঘটনায় জড়িত হিসেবে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর সম্পৃক্ততার প্রমাণ মেলে, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি এ মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি।
পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন যে ওই হামলার জন্য আর্জেস গ্রেনেড সরবরাহ করেছিলেন, তাও এখন প্রমাণিত সত্য। কিন্তু এখন মামলাটির অধিকতর তদন্তে বেরিয়ে আসছে, শুধু আবদুস সালাম পিন্টুই নন, তত্কালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরেরও সম্পৃক্ততা রয়েছে। অন্তত বাবর যে প্রকৃত অপরাধীদের বাঁচাতে তখন তদন্তকে ভিন্ন খাতে নিতে ভূমিকা রেখেছিলেন, তাতে আর সন্দেহের অবকাশ নেই।
কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আরও বড় বা গুরুত্বপূর্ণ কেউ ওই হামলার নেপথ্যে ছিলেন কি না? বা, আগে থেকে হামলার ঘটনা জানতেন কি না, বা পরে প্রকৃত সত্য জেনেও ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নিতে সায় দিয়েছিলেন কি না? তবে এমন কারও নাম যদি বেরিয়েও আসে, আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না—বর্তমান তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও তত্কালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউর সমাবেশে সেই গ্রেনেড হামলার সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কারও সম্পৃক্ততার প্রমাণ যদি মেলে, তাহলে এটা বিশ্বাস করতে হবে যে কতিপয় ব্যক্তিবিশেষ নয়, তৎকালীন সরকারের অনেকেই ওই নৃশংস হামলায় জড়িত। কারণ ইতিমধ্যে তৎকালীন তিনজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে বলেছেন, কীভাবে গ্রেনেড সরবরাহকারী তাজউদ্দিনকে বিদেশে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছে বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থা।
২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের প্রধান নেতারা অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন। তবে আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২২ নেতা-কর্মী নিহত হয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন শতাধিক। আহত ব্যক্তিদের অনেকেই পঙ্গু হয়ে গেছেন। তাঁদের অনেকেই আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি।
২০০৪ সালের ২১ আগস্টের পর তৎকালীন জোট সরকারের নেতারা জাতীয় সংসদের ভেতরে ও বাইরে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে এ কথা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব নিজেরাই ওই ঘটনা ঘটিয়েছেন। তারপর মামলার তদন্ত নিয়ে যে কত রকম গল্প বানানো ও প্রচার করা হয়েছিল, সেসব তো দেশবাসীর জানা হয়ে গেছে।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার শুধু বিভ্রান্তিকর প্রচারই চালায়নি, ২১ আগস্ট মামলাটির তদন্তের নামে কার্যত সুদূরপ্রসারী একটি ষড়যন্ত্রকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। সশস্ত্র বাহিনী-সমর্থিত বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে গ্রেনেড হামলার ঘটনার নেপথ্যের অনেক কথাই বেরিয়ে আসতে শুরু করে। তবে তারও আগে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ঘটনার পর থেকে, প্রথম আলোর নিজস্ব অনুসন্ধানে বহু নতুন তথ্যসহ প্রায় পুরো ঘটনা নিয়ে ষড়যন্ত্রমূলক তত্পরতার বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ করেছিল। জোট সরকার জেনেশুনে যে সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রকৃত আসামিদের আড়াল করার চেষ্টা করেছিল, তদন্তকে উল্টোপথে পরিচালনা করেছিল—সেসব তখনই আমরা প্রথম আলোতে তুলে ধরে দেশবাসীকে জানিয়েছিলাম। এখন বিলম্বে হলেও তদন্তে আরও সত্য বের হয়ে এসেছে।
আমরা আশা করব, সিআইডি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যথাসম্ভব দ্রুত এই মামলার অধিকতর তদন্ত শেষ করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেবে। এবং যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় মামলাটির বিচারকাজ দ্রুত শেষ করে ভয়ংকর এই হামলার হোতা ও নেপথ্যের চক্রান্তকারীদের বিচারের সম্মুখীন করা হবে।
আমরা জানি, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের অন্যতম শীর্ষ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর রাজধানীর বাড্ডা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তখন যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রে (জেআইসি) মুফতি হান্নান ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছিলেন এবং এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছিলেন। সে সময় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায়। কিন্তু তখন মুফতি হান্নানকে এই মামলার আসামি করা বা তাঁর কাছ থেকে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়ার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি মুফতি হান্নান গ্রেনেড আক্রমণকারী ও সহযোগী হিসেবে যাঁদের নাম প্রকাশ করেছিলেন, তাঁদেরও গ্রেপ্তারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তাঁরা তখন প্রকাশ্যেই সক্রিয় ছিলেন।
মুফতি হান্নান ওই সময়ে অর্থাৎ বিগত জোট সরকারের আমলেই জিজ্ঞাসাবাদে গোয়েন্দাদের কাছে ২১ আগস্টের হামলা সম্পর্কে যেসব তথ্য ও বর্ণনা দিয়েছিলেন, তা আমাদের হাতে রয়েছে। এসব তথ্যের সঙ্গে পরে দুই দফা আদালতে দেওয়া হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির মিল পাওয়া যায়। মুফতি হান্নানসহ অন্যান্য জঙ্গির দেওয়া স্বীকারোক্তি এবং শেখ হাসিনাকে চারবার হত্যাচেষ্টার ঘটনার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনসহ আরও প্রতিবেদন নিয়ে ২০০৮ সালের ২১ আগস্ট পুরো চার পৃষ্ঠার বিশেষ প্রথম আলো প্রকাশিত হয়েছিল। তারও আগে ২০০৫, ২০০৬ ও ২০০৭ সালে এই ভয়ংকর ঘটনা নিয়ে অনেক বিশেষ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে হামলাকারী এবং এর নেপথ্যের ব্যক্তি ও শক্তির মুখোশ উন্মোচনের প্রয়াস চালানো হয়।
২০০৭ সালের অক্টোবরে র্যাব মুফতি হান্নানের সহযোগী নয় জঙ্গিকে অস্ত্র, গ্রেনেড, বিস্ফোরকসহ বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করে। এঁদের মধ্যে ২১ আগস্টের হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল ও জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন। মুফতি হান্নান এবং এই দুজনসহ ছয় জঙ্গি ওই বছরের নভেম্বরে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এঁদের জবানবন্দি যাচাই-বাছাই করে পরিকল্পনা, গ্রেনেড সরবরাহ, আক্রমণ ও আক্রমণে সহায়তাকারী ২৭ জনের নাম বেরিয়ে এসেছিল। সর্বশেষ ২০০৮ সালের ১৭ জানুয়ারি গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুকে। অবশ্য এর আগে তাঁকে একবার ধরে একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার চাপে আবার ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। হামলার তিন দিন আগে সাবেক এই উপমন্ত্রীর ধানমন্ডির বাসায় জঙ্গিরা এক পরিকল্পনা বৈঠক করেছিল বলে মুফতি হান্নান আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন। আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় অপরাধী হিসেবে যাঁর নাম এসেছে, তাঁকে ধরে আবার ছেড়ে দেওয়াটা ছিল নজিরবিহীন। তার ওপর মামলাটি এমন চাঞ্চল্যকর এবং ব্যক্তিটি সাধারণ কেউ নন যে ভুল করে বা না জেনেশুনে ধরা হয়েছিল।
সিআইডির তদন্তে গ্রেনেড আক্রমণে সরাসরি অংশগ্রহণকারী হিসেবে শনাক্ত হওয়া বাংলাদেশের হরকাতুল জিহাদের দুই সদস্য মুরসালিন ও মুত্তাকিন এখন ভারতের তিহার জেলে বন্দী। নাশকতার জন্য অস্ত্র-বিস্ফোরক বহনের দায়ে এই যমজ দুই ভাইকে ২০০৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি দিল্লির পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাদের বাড়ি বাংলাদেশের ফরিদপুরে। ২১ আগস্ট আক্রমণে অংশ নেওয়া আরেকজন মুফতি আহসান উল্লাহ ওরফে কাজল একই বছরের ৮ মার্চ দিল্লির পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। কাজল ভারতে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড চালাতে গিয়ে পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তাইয়েবার শীর্ষস্থানীয় জঙ্গি ইয়াজদানির সঙ্গে নিহত হন বলে ভারতীয় পত্রিকায় খবর বের হয়েছে।
মুফতি হান্নানসহ হরকাতুল জিহাদের বেশির ভাগ নেতাই আফগানিস্তানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাঁদের সঙ্গে আফগানিস্তান, ভারত ও পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনের পাশাপাশি ভারতে তত্পর জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গেও যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে, তা এখন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
মুফতি হান্নান ও গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, এটা পরিষ্কার যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মূল লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের হত্যা করা। অথচ আমরা দেখেছি, ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পক্ষ থেকে এমন অবিশ্বাস্য কথাও প্রচার করা হয়েছিল যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বই জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন পেতে ওই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিলেন। তাদের বক্তব্য ছিল, গ্রেনেড হামলা এমনভাবে করা হয়েছে, যেন শেখ হাসিনা বেঁচে যান এবং জোট সরকারকে একটি বিব্রতকর অবস্থায় ফেলা যায়। দেশে একটি চরম অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি হয় এবং জনসমর্থন ও সহানুভূতি আওয়ামী লীগের পক্ষে যায়। তখন এ ধরনের বক্তব্য কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়নি।
মনে পড়ে, ২১ আগস্টের ঘটনার কিছুদিন পর তৎকালীন পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত এই প্রতিবেদককে প্রায় একই রকম কথা বলেছিলেন। তিনিও বলেছিলেন, এটা আওয়ামী লীগেরই কাজ। এ ঘটনায় তারাই তো লাভবান হবে। তারা সহানুভূতি পাবে। এমনকি ঘটনার আগমুহূর্তে শেখ হাসিনা আইভি রহমানকে মঞ্চে ডেকে নিতে চেয়েছিলেন। সে কথাও তিনি বলেছিলেন। শেখ হাসিনার জ্ঞাতসারেই এ ঘটনা ঘটেছে বলে ওই পাকিস্তানি কূটনীতিক বলেছিলেন। পাকিস্তানি হাইকমিশনার ও বিএনপির নেতাদের বক্তব্যে কী আশ্চর্য মিল!
২১ আগস্টের ঘটনাবলির পরপরই দুই নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং সাবেক বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের সরাসরি কথা বলার সুযোগ হয়েছিল।
মনে আছে, ২৫ আগস্ট অপরাহ্নে বেগম জিয়ার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দীর্ঘ আলোচনার সময় তারেক রহমানও উপস্থিত ছিলেন। সে সময় খালেদা জিয়ার আমন্ত্রণে পত্রিকার সম্পাদকেরা তাঁর সঙ্গে আলাদাভাবে দেখা করেছিলেন।
বেগম জিয়া শুরুতেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কারা এ ঘটনা ঘটাতে পারে বলে আপনি মনে করেন? আমার সরাসরি উত্তর ছিল, ‘সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের পক্ষে বলা মুশকিল। তবে হরকাতুল জিহাদ, ভারতের আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যাকারীদের সংগঠন ফ্রিডম পার্টি প্রভৃতি এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। এসব গোষ্ঠীর মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকতে পারে। তারা পরস্পরকে সাহায্য-সহযোগিতা করে বলেও শোনা যায়।’
বেগম জিয়া শুরুতেই ‘ফ্রিডম পার্টির এখন আর অস্তিত্ব নেই’ বলে তাদের জড়িত থাকার সম্ভাবনা নাকচ করে দেন। কিন্তু হরকাতুল জিহাদ ও উলফা সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি। আমার এখনো মনে পড়ে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সেই আলোচনাটি ছিল বেশ উত্তেজনাপূর্ণ, তর্ক-বিতর্কও হয়েছিল বেশ। সেদিন অপরাহ্নের আলোচনায় বেগম জিয়া বারবার আওয়ামী লীগকে শায়েস্তা করা হবে এবং কিছুতেই ১৯৯৬ সালের অবস্থা তৈরি করতে দেবেন না বলে জানিয়েছিলেন।
ঘটনার চার দিন পর ২৬ আগস্ট সকালে দেখা হয়েছিল বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। শেখ হাসিনা ও তাঁর দলের নেতৃত্বের প্রতি নৃশংস হামলার ঘটনায় সমবেদনা ও সহানুভূতি প্রকাশই ছিল ওই সাক্ষাতের উদ্দেশ্য। তখন স্বাভাবিক কারণেই শেখ হাসিনা গভীরভাবে ব্যথিত ছিলেন। আহত নেতা-কর্মীরা আসছিলেন তাঁর কাছে। একটা অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছিল সুধা সদনে। বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন শেখ হাসিনা। তবে তাঁর স্পষ্ট অভিযোগ ছিল, ‘তারেক রহমান আর বাবর এবং হাওয়া ভবনের তাঁর সঙ্গীরা হামলার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। তাঁরাই পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। আমাকে হত্যা এবং আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করাই ছিল এই হামলার উদ্দেশ্য।’
তখন গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য আওয়ামী লীগ ছাড়াও প্রতিবেশী ভারতের প্রতিও অঙ্গুলিনির্দেশ করা হয়েছিল। গোয়েন্দাদের কাছ থেকে পাওয়া দাবি করে ওই সব মিথ্যা তথ্য জোট সরকারের সমর্থক পত্রপত্রিকায় প্রচারও করা হয়েছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সমর্থক কতিপয় লেখক ও বুদ্ধিজীবী সভা-সেমিনারে একই সুরে বক্তব্য দিয়ে, পত্রিকায় কলাম লিখে সেই মিথ্যা প্রচারে সহায়তাও করেছিলেন।
এ ছাড়া ২১ আগস্ট হামলার পরপর গঠিত সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনেও ওই হামলার সঙ্গে প্রতিবেশী একটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। দুই মাসের কম সময়ের মধ্যে কমিশন তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান ব্রি. জে. আবদুর রহিমও একই কথা বলেছেন। আসলে সেসবই হয়েছিল ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’।
জানা যায়, জোট সরকারের আমলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এবং জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার তখনকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ ধরনের মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করেছিলেন নানা মহলে। গণমাধ্যমকেও বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করেছিলেন যে কলকাতায় পলাতক শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের পরিকল্পনায় ১৪ জনের একটি দল এই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। আর, সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ভারতের বসিরহাট থেকে গ্রেনেড এনেছিল ঢাকার বাড্ডার সন্ত্রাসী মুকুল। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটেছে। পরে এ ঘটনায় জড়িত থাকার মিথ্যা অভিযোগে সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার রাজধানীর মগবাজারের আওয়ামী লীগের নেতা মোখলেসুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তিনি জামিনে বের হয়ে সাংবাদিকদের জানান, সিআইডির কর্মকর্তারা তাঁকে রাজসাক্ষী বানানোর কথা বলে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে আদালতে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য চাপ দিয়েছিলেন।
একইভাবে তদন্তকে ভিন্ন খাতে নিতে ২০০৫ সালের জুন মাসে জজ মিয়া নামের এক ভবঘুরেকে নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এই জজ মিয়াকে দিয়ে সিআইডি তখন আদালতে কথিত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করে। তাতে নাকি জজ মিয়া বলেছিলেন, সামান্য টাকার বিনিময়ে সুব্রত বাইনের পরিকল্পনা ও নির্দেশে তিনি নিজেসহ ১৪ জনের একটি দল এই গ্রেনেড হামলায় জড়িত ছিল। তবে ওই জবানবন্দিতে জজ মিয়া বলেছিলেন, এর আগে তিনি গ্রেনেড কী জিনিস চোখে দেখেননি। বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ফটকে খালি জায়গায় বসে কীভাবে গ্রেনেড ছুড়তে হয়, কীভাবে হামলা করতে হবে, তা সুব্রত বাইনরা বলে দিয়েছিল এবং সেভাবে হামলা করা হয়েছিল।
সিআইডি ও পুলিশের ‘জজ মিয়া উদ্ভাবন-তত্ত্ব’ আমরা তখনই নাকচ করেছিলাম। এবং শিশির ভট্টাচার্য্যের একটি কার্টুনসহ প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে জজ মিয়ার কাহিনিকে ‘আষাঢ়ে গল্প’ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল (২৯ জুন, ২০০৫; দেখুন পৃষ্ঠা ১৫)। এর পরপরই এক সামাজিক অনুষ্ঠানে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর আমাদের বলেছিলেন, ‘আষাঢ়ে গল্প বলছেন আপনারা, আমরা সত্য প্রকাশ করে প্রমাণ করে দেব, কীভাবে সীমান্তের ওপার থেকে পরিকল্পনা হয়েছে, কীভাবে সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও তার সঙ্গীরা এই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে।’
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পটপরিবর্তনের পর পুরো পরিস্থিতি পাল্টে যায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার জোট আমলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা তখন বলার চেষ্টা করেছেন যে পুলিশ ও সিআইডি তাঁদের ভুল বুঝিয়েছিল।
সর্বশেষ যেসব তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে আমাদের সন্দেহই সত্য বলে প্রমাণিত হলো। এটা এখন প্রায় পরিষ্কার যে তত্কালীন জোট সরকারের উচ্চপর্যায়ের পরামর্শেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা, সিআইডি ও পুলিশের তখনকার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার তদন্তকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁরা পেশাদার খুনি চক্র, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এবং ভারতের ওপর এই হামলার দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করে প্রকৃত অপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। উদ্দেশ্যমূলকভাবে মামলার আলামত নষ্ট করা হয়েছিল। তত্কালীন সরকারের আহ্বানে বিদেশ থেকে আসা ইন্টারপোল ও এফবিআইয়ের বিশেষজ্ঞদের ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল। অবশ্য বিদেশি বিশেষজ্ঞদের আনাটা ছিল লোক দেখানো একটি কৌশল মাত্র।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের পরামর্শে জজ মিয়াকে দিয়ে ‘আষাঢ়ে গল্প’ সাজাতে পুলিশ ও সিআইডির তৎকালীন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং মামলার তদন্তে সংশ্লিষ্ট সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সহকারী পুলিশ সুপার আবদুর রশিদ সহায়তা করেছেন। এরপর তদন্তের দায়িত্বে আসা সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সী আতিকুর রহমানও জেনেবুঝে পূর্ববর্তীদের অনুসরণ করেন। এখন সিআইডির এই তিন কর্মকর্তাই অবসরে আছেন। কেন মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়েছিল, তা খতিয়ে দেখতে সাবেক এই তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্তের শেষ কী হলো জানা যায়নি।
একই সঙ্গে এটাও তদন্ত হওয়া উচিত, জোট সরকারের শাসনামলে মুফতি হান্নানকে বিভিন্ন মামলায় টানা ১৪৫ দিন রিমান্ডে রেখে কারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন, জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য কেন, কার নির্দেশে বা কিসের বিনিময়ে গোপন রাখা হয়েছিল; এসবের নেপথ্যে কারা কারা ছিলেন, সেসবও এখন অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গেছে।
সম্প্রতি প্রথম আলোর অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, জোট সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থাকে সে সময়ে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা সম্পর্কে তদন্ত করতে নিষেধ করা হয়েছিল। তত্কালীন স্বরাষ্ট্রসচিব ওমর ফারুক ও সরকারের পছন্দের সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের দিয়ে ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্যমূলক তদন্ত করিয়েছিলেন। আসলে কোনো তদন্তই করা হয়নি। এসব তথ্যের পটভূমিতে এখন যে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন যে, তাহলে কি ২১ আগস্টের হামলার সঙ্গে জোট সরকারের উচ্চপর্যায়ের যোগসাজশ ছিল? এখন তো সে রকম তথ্য বের হয়ে আসছে বলে তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে।
এটা সত্যি বিশ্বাস করা কঠিন যে বাংলাদেশের একটি নির্বাচিত সরকার ও নেতৃত্ব কীভাবে তাঁদের বিরোধী শক্তিকে ধ্বংস করতে, কী নির্লজ্জভাবে সত্যকে উল্টো পথে পরিচালনা করতে পারেন! এভাবেই উগ্র জঙ্গিদের একের পর এক হত্যাকাণ্ড ও গ্রেনেড হামলার ঘটনাকে লুকানো বা ভিন্ন পথে পরিচালনা করতে জোট সরকার সচেষ্ট ছিল। এই সবকিছু তো বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অজ্ঞাতে হতে পারে না। এর দায় এড়াতে পারেন না বিএনপির নেতৃত্ব। এসব ঘটনা জাতির জন্য একটি ভয়ংকর কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবেই বিবেচিত হবে।
আমরা ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার অধিকতর তদন্ত শেষ করে দ্রুত বিচার ও প্রকৃত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই। একই সঙ্গে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সমবেদনা জানাই।
মতিউর রহমান: সম্পাদক, প্রথম আলো।
পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন যে ওই হামলার জন্য আর্জেস গ্রেনেড সরবরাহ করেছিলেন, তাও এখন প্রমাণিত সত্য। কিন্তু এখন মামলাটির অধিকতর তদন্তে বেরিয়ে আসছে, শুধু আবদুস সালাম পিন্টুই নন, তত্কালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরেরও সম্পৃক্ততা রয়েছে। অন্তত বাবর যে প্রকৃত অপরাধীদের বাঁচাতে তখন তদন্তকে ভিন্ন খাতে নিতে ভূমিকা রেখেছিলেন, তাতে আর সন্দেহের অবকাশ নেই।
কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আরও বড় বা গুরুত্বপূর্ণ কেউ ওই হামলার নেপথ্যে ছিলেন কি না? বা, আগে থেকে হামলার ঘটনা জানতেন কি না, বা পরে প্রকৃত সত্য জেনেও ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নিতে সায় দিয়েছিলেন কি না? তবে এমন কারও নাম যদি বেরিয়েও আসে, আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না—বর্তমান তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও তত্কালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউর সমাবেশে সেই গ্রেনেড হামলার সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কারও সম্পৃক্ততার প্রমাণ যদি মেলে, তাহলে এটা বিশ্বাস করতে হবে যে কতিপয় ব্যক্তিবিশেষ নয়, তৎকালীন সরকারের অনেকেই ওই নৃশংস হামলায় জড়িত। কারণ ইতিমধ্যে তৎকালীন তিনজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে বলেছেন, কীভাবে গ্রেনেড সরবরাহকারী তাজউদ্দিনকে বিদেশে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছে বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থা।
২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের প্রধান নেতারা অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন। তবে আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২২ নেতা-কর্মী নিহত হয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন শতাধিক। আহত ব্যক্তিদের অনেকেই পঙ্গু হয়ে গেছেন। তাঁদের অনেকেই আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি।
২০০৪ সালের ২১ আগস্টের পর তৎকালীন জোট সরকারের নেতারা জাতীয় সংসদের ভেতরে ও বাইরে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে এ কথা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব নিজেরাই ওই ঘটনা ঘটিয়েছেন। তারপর মামলার তদন্ত নিয়ে যে কত রকম গল্প বানানো ও প্রচার করা হয়েছিল, সেসব তো দেশবাসীর জানা হয়ে গেছে।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার শুধু বিভ্রান্তিকর প্রচারই চালায়নি, ২১ আগস্ট মামলাটির তদন্তের নামে কার্যত সুদূরপ্রসারী একটি ষড়যন্ত্রকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। সশস্ত্র বাহিনী-সমর্থিত বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে গ্রেনেড হামলার ঘটনার নেপথ্যের অনেক কথাই বেরিয়ে আসতে শুরু করে। তবে তারও আগে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ঘটনার পর থেকে, প্রথম আলোর নিজস্ব অনুসন্ধানে বহু নতুন তথ্যসহ প্রায় পুরো ঘটনা নিয়ে ষড়যন্ত্রমূলক তত্পরতার বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ করেছিল। জোট সরকার জেনেশুনে যে সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রকৃত আসামিদের আড়াল করার চেষ্টা করেছিল, তদন্তকে উল্টোপথে পরিচালনা করেছিল—সেসব তখনই আমরা প্রথম আলোতে তুলে ধরে দেশবাসীকে জানিয়েছিলাম। এখন বিলম্বে হলেও তদন্তে আরও সত্য বের হয়ে এসেছে।
আমরা আশা করব, সিআইডি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যথাসম্ভব দ্রুত এই মামলার অধিকতর তদন্ত শেষ করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেবে। এবং যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় মামলাটির বিচারকাজ দ্রুত শেষ করে ভয়ংকর এই হামলার হোতা ও নেপথ্যের চক্রান্তকারীদের বিচারের সম্মুখীন করা হবে।
আমরা জানি, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের অন্যতম শীর্ষ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর রাজধানীর বাড্ডা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তখন যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রে (জেআইসি) মুফতি হান্নান ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছিলেন এবং এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছিলেন। সে সময় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায়। কিন্তু তখন মুফতি হান্নানকে এই মামলার আসামি করা বা তাঁর কাছ থেকে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়ার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি মুফতি হান্নান গ্রেনেড আক্রমণকারী ও সহযোগী হিসেবে যাঁদের নাম প্রকাশ করেছিলেন, তাঁদেরও গ্রেপ্তারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তাঁরা তখন প্রকাশ্যেই সক্রিয় ছিলেন।
মুফতি হান্নান ওই সময়ে অর্থাৎ বিগত জোট সরকারের আমলেই জিজ্ঞাসাবাদে গোয়েন্দাদের কাছে ২১ আগস্টের হামলা সম্পর্কে যেসব তথ্য ও বর্ণনা দিয়েছিলেন, তা আমাদের হাতে রয়েছে। এসব তথ্যের সঙ্গে পরে দুই দফা আদালতে দেওয়া হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির মিল পাওয়া যায়। মুফতি হান্নানসহ অন্যান্য জঙ্গির দেওয়া স্বীকারোক্তি এবং শেখ হাসিনাকে চারবার হত্যাচেষ্টার ঘটনার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনসহ আরও প্রতিবেদন নিয়ে ২০০৮ সালের ২১ আগস্ট পুরো চার পৃষ্ঠার বিশেষ প্রথম আলো প্রকাশিত হয়েছিল। তারও আগে ২০০৫, ২০০৬ ও ২০০৭ সালে এই ভয়ংকর ঘটনা নিয়ে অনেক বিশেষ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে হামলাকারী এবং এর নেপথ্যের ব্যক্তি ও শক্তির মুখোশ উন্মোচনের প্রয়াস চালানো হয়।
২০০৭ সালের অক্টোবরে র্যাব মুফতি হান্নানের সহযোগী নয় জঙ্গিকে অস্ত্র, গ্রেনেড, বিস্ফোরকসহ বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করে। এঁদের মধ্যে ২১ আগস্টের হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল ও জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন। মুফতি হান্নান এবং এই দুজনসহ ছয় জঙ্গি ওই বছরের নভেম্বরে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এঁদের জবানবন্দি যাচাই-বাছাই করে পরিকল্পনা, গ্রেনেড সরবরাহ, আক্রমণ ও আক্রমণে সহায়তাকারী ২৭ জনের নাম বেরিয়ে এসেছিল। সর্বশেষ ২০০৮ সালের ১৭ জানুয়ারি গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুকে। অবশ্য এর আগে তাঁকে একবার ধরে একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার চাপে আবার ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। হামলার তিন দিন আগে সাবেক এই উপমন্ত্রীর ধানমন্ডির বাসায় জঙ্গিরা এক পরিকল্পনা বৈঠক করেছিল বলে মুফতি হান্নান আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন। আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় অপরাধী হিসেবে যাঁর নাম এসেছে, তাঁকে ধরে আবার ছেড়ে দেওয়াটা ছিল নজিরবিহীন। তার ওপর মামলাটি এমন চাঞ্চল্যকর এবং ব্যক্তিটি সাধারণ কেউ নন যে ভুল করে বা না জেনেশুনে ধরা হয়েছিল।
সিআইডির তদন্তে গ্রেনেড আক্রমণে সরাসরি অংশগ্রহণকারী হিসেবে শনাক্ত হওয়া বাংলাদেশের হরকাতুল জিহাদের দুই সদস্য মুরসালিন ও মুত্তাকিন এখন ভারতের তিহার জেলে বন্দী। নাশকতার জন্য অস্ত্র-বিস্ফোরক বহনের দায়ে এই যমজ দুই ভাইকে ২০০৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি দিল্লির পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাদের বাড়ি বাংলাদেশের ফরিদপুরে। ২১ আগস্ট আক্রমণে অংশ নেওয়া আরেকজন মুফতি আহসান উল্লাহ ওরফে কাজল একই বছরের ৮ মার্চ দিল্লির পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। কাজল ভারতে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড চালাতে গিয়ে পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তাইয়েবার শীর্ষস্থানীয় জঙ্গি ইয়াজদানির সঙ্গে নিহত হন বলে ভারতীয় পত্রিকায় খবর বের হয়েছে।
মুফতি হান্নানসহ হরকাতুল জিহাদের বেশির ভাগ নেতাই আফগানিস্তানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাঁদের সঙ্গে আফগানিস্তান, ভারত ও পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনের পাশাপাশি ভারতে তত্পর জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গেও যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে, তা এখন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
মুফতি হান্নান ও গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, এটা পরিষ্কার যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মূল লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের হত্যা করা। অথচ আমরা দেখেছি, ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পক্ষ থেকে এমন অবিশ্বাস্য কথাও প্রচার করা হয়েছিল যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বই জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন পেতে ওই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিলেন। তাদের বক্তব্য ছিল, গ্রেনেড হামলা এমনভাবে করা হয়েছে, যেন শেখ হাসিনা বেঁচে যান এবং জোট সরকারকে একটি বিব্রতকর অবস্থায় ফেলা যায়। দেশে একটি চরম অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি হয় এবং জনসমর্থন ও সহানুভূতি আওয়ামী লীগের পক্ষে যায়। তখন এ ধরনের বক্তব্য কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়নি।
মনে পড়ে, ২১ আগস্টের ঘটনার কিছুদিন পর তৎকালীন পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত এই প্রতিবেদককে প্রায় একই রকম কথা বলেছিলেন। তিনিও বলেছিলেন, এটা আওয়ামী লীগেরই কাজ। এ ঘটনায় তারাই তো লাভবান হবে। তারা সহানুভূতি পাবে। এমনকি ঘটনার আগমুহূর্তে শেখ হাসিনা আইভি রহমানকে মঞ্চে ডেকে নিতে চেয়েছিলেন। সে কথাও তিনি বলেছিলেন। শেখ হাসিনার জ্ঞাতসারেই এ ঘটনা ঘটেছে বলে ওই পাকিস্তানি কূটনীতিক বলেছিলেন। পাকিস্তানি হাইকমিশনার ও বিএনপির নেতাদের বক্তব্যে কী আশ্চর্য মিল!
২১ আগস্টের ঘটনাবলির পরপরই দুই নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং সাবেক বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের সরাসরি কথা বলার সুযোগ হয়েছিল।
মনে আছে, ২৫ আগস্ট অপরাহ্নে বেগম জিয়ার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দীর্ঘ আলোচনার সময় তারেক রহমানও উপস্থিত ছিলেন। সে সময় খালেদা জিয়ার আমন্ত্রণে পত্রিকার সম্পাদকেরা তাঁর সঙ্গে আলাদাভাবে দেখা করেছিলেন।
বেগম জিয়া শুরুতেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কারা এ ঘটনা ঘটাতে পারে বলে আপনি মনে করেন? আমার সরাসরি উত্তর ছিল, ‘সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের পক্ষে বলা মুশকিল। তবে হরকাতুল জিহাদ, ভারতের আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যাকারীদের সংগঠন ফ্রিডম পার্টি প্রভৃতি এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। এসব গোষ্ঠীর মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকতে পারে। তারা পরস্পরকে সাহায্য-সহযোগিতা করে বলেও শোনা যায়।’
বেগম জিয়া শুরুতেই ‘ফ্রিডম পার্টির এখন আর অস্তিত্ব নেই’ বলে তাদের জড়িত থাকার সম্ভাবনা নাকচ করে দেন। কিন্তু হরকাতুল জিহাদ ও উলফা সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি। আমার এখনো মনে পড়ে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সেই আলোচনাটি ছিল বেশ উত্তেজনাপূর্ণ, তর্ক-বিতর্কও হয়েছিল বেশ। সেদিন অপরাহ্নের আলোচনায় বেগম জিয়া বারবার আওয়ামী লীগকে শায়েস্তা করা হবে এবং কিছুতেই ১৯৯৬ সালের অবস্থা তৈরি করতে দেবেন না বলে জানিয়েছিলেন।
ঘটনার চার দিন পর ২৬ আগস্ট সকালে দেখা হয়েছিল বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। শেখ হাসিনা ও তাঁর দলের নেতৃত্বের প্রতি নৃশংস হামলার ঘটনায় সমবেদনা ও সহানুভূতি প্রকাশই ছিল ওই সাক্ষাতের উদ্দেশ্য। তখন স্বাভাবিক কারণেই শেখ হাসিনা গভীরভাবে ব্যথিত ছিলেন। আহত নেতা-কর্মীরা আসছিলেন তাঁর কাছে। একটা অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছিল সুধা সদনে। বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন শেখ হাসিনা। তবে তাঁর স্পষ্ট অভিযোগ ছিল, ‘তারেক রহমান আর বাবর এবং হাওয়া ভবনের তাঁর সঙ্গীরা হামলার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। তাঁরাই পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। আমাকে হত্যা এবং আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করাই ছিল এই হামলার উদ্দেশ্য।’
তখন গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য আওয়ামী লীগ ছাড়াও প্রতিবেশী ভারতের প্রতিও অঙ্গুলিনির্দেশ করা হয়েছিল। গোয়েন্দাদের কাছ থেকে পাওয়া দাবি করে ওই সব মিথ্যা তথ্য জোট সরকারের সমর্থক পত্রপত্রিকায় প্রচারও করা হয়েছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সমর্থক কতিপয় লেখক ও বুদ্ধিজীবী সভা-সেমিনারে একই সুরে বক্তব্য দিয়ে, পত্রিকায় কলাম লিখে সেই মিথ্যা প্রচারে সহায়তাও করেছিলেন।
এ ছাড়া ২১ আগস্ট হামলার পরপর গঠিত সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনেও ওই হামলার সঙ্গে প্রতিবেশী একটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। দুই মাসের কম সময়ের মধ্যে কমিশন তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান ব্রি. জে. আবদুর রহিমও একই কথা বলেছেন। আসলে সেসবই হয়েছিল ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’।
জানা যায়, জোট সরকারের আমলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এবং জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার তখনকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ ধরনের মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করেছিলেন নানা মহলে। গণমাধ্যমকেও বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করেছিলেন যে কলকাতায় পলাতক শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের পরিকল্পনায় ১৪ জনের একটি দল এই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। আর, সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ভারতের বসিরহাট থেকে গ্রেনেড এনেছিল ঢাকার বাড্ডার সন্ত্রাসী মুকুল। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটেছে। পরে এ ঘটনায় জড়িত থাকার মিথ্যা অভিযোগে সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার রাজধানীর মগবাজারের আওয়ামী লীগের নেতা মোখলেসুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তিনি জামিনে বের হয়ে সাংবাদিকদের জানান, সিআইডির কর্মকর্তারা তাঁকে রাজসাক্ষী বানানোর কথা বলে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে আদালতে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য চাপ দিয়েছিলেন।
একইভাবে তদন্তকে ভিন্ন খাতে নিতে ২০০৫ সালের জুন মাসে জজ মিয়া নামের এক ভবঘুরেকে নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এই জজ মিয়াকে দিয়ে সিআইডি তখন আদালতে কথিত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করে। তাতে নাকি জজ মিয়া বলেছিলেন, সামান্য টাকার বিনিময়ে সুব্রত বাইনের পরিকল্পনা ও নির্দেশে তিনি নিজেসহ ১৪ জনের একটি দল এই গ্রেনেড হামলায় জড়িত ছিল। তবে ওই জবানবন্দিতে জজ মিয়া বলেছিলেন, এর আগে তিনি গ্রেনেড কী জিনিস চোখে দেখেননি। বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ফটকে খালি জায়গায় বসে কীভাবে গ্রেনেড ছুড়তে হয়, কীভাবে হামলা করতে হবে, তা সুব্রত বাইনরা বলে দিয়েছিল এবং সেভাবে হামলা করা হয়েছিল।
সিআইডি ও পুলিশের ‘জজ মিয়া উদ্ভাবন-তত্ত্ব’ আমরা তখনই নাকচ করেছিলাম। এবং শিশির ভট্টাচার্য্যের একটি কার্টুনসহ প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে জজ মিয়ার কাহিনিকে ‘আষাঢ়ে গল্প’ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল (২৯ জুন, ২০০৫; দেখুন পৃষ্ঠা ১৫)। এর পরপরই এক সামাজিক অনুষ্ঠানে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর আমাদের বলেছিলেন, ‘আষাঢ়ে গল্প বলছেন আপনারা, আমরা সত্য প্রকাশ করে প্রমাণ করে দেব, কীভাবে সীমান্তের ওপার থেকে পরিকল্পনা হয়েছে, কীভাবে সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও তার সঙ্গীরা এই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে।’
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পটপরিবর্তনের পর পুরো পরিস্থিতি পাল্টে যায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার জোট আমলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা তখন বলার চেষ্টা করেছেন যে পুলিশ ও সিআইডি তাঁদের ভুল বুঝিয়েছিল।
সর্বশেষ যেসব তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে আমাদের সন্দেহই সত্য বলে প্রমাণিত হলো। এটা এখন প্রায় পরিষ্কার যে তত্কালীন জোট সরকারের উচ্চপর্যায়ের পরামর্শেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা, সিআইডি ও পুলিশের তখনকার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার তদন্তকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁরা পেশাদার খুনি চক্র, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এবং ভারতের ওপর এই হামলার দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করে প্রকৃত অপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। উদ্দেশ্যমূলকভাবে মামলার আলামত নষ্ট করা হয়েছিল। তত্কালীন সরকারের আহ্বানে বিদেশ থেকে আসা ইন্টারপোল ও এফবিআইয়ের বিশেষজ্ঞদের ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল। অবশ্য বিদেশি বিশেষজ্ঞদের আনাটা ছিল লোক দেখানো একটি কৌশল মাত্র।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের পরামর্শে জজ মিয়াকে দিয়ে ‘আষাঢ়ে গল্প’ সাজাতে পুলিশ ও সিআইডির তৎকালীন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং মামলার তদন্তে সংশ্লিষ্ট সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সহকারী পুলিশ সুপার আবদুর রশিদ সহায়তা করেছেন। এরপর তদন্তের দায়িত্বে আসা সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সী আতিকুর রহমানও জেনেবুঝে পূর্ববর্তীদের অনুসরণ করেন। এখন সিআইডির এই তিন কর্মকর্তাই অবসরে আছেন। কেন মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়েছিল, তা খতিয়ে দেখতে সাবেক এই তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্তের শেষ কী হলো জানা যায়নি।
একই সঙ্গে এটাও তদন্ত হওয়া উচিত, জোট সরকারের শাসনামলে মুফতি হান্নানকে বিভিন্ন মামলায় টানা ১৪৫ দিন রিমান্ডে রেখে কারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন, জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য কেন, কার নির্দেশে বা কিসের বিনিময়ে গোপন রাখা হয়েছিল; এসবের নেপথ্যে কারা কারা ছিলেন, সেসবও এখন অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গেছে।
সম্প্রতি প্রথম আলোর অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, জোট সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থাকে সে সময়ে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা সম্পর্কে তদন্ত করতে নিষেধ করা হয়েছিল। তত্কালীন স্বরাষ্ট্রসচিব ওমর ফারুক ও সরকারের পছন্দের সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের দিয়ে ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্যমূলক তদন্ত করিয়েছিলেন। আসলে কোনো তদন্তই করা হয়নি। এসব তথ্যের পটভূমিতে এখন যে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন যে, তাহলে কি ২১ আগস্টের হামলার সঙ্গে জোট সরকারের উচ্চপর্যায়ের যোগসাজশ ছিল? এখন তো সে রকম তথ্য বের হয়ে আসছে বলে তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে।
এটা সত্যি বিশ্বাস করা কঠিন যে বাংলাদেশের একটি নির্বাচিত সরকার ও নেতৃত্ব কীভাবে তাঁদের বিরোধী শক্তিকে ধ্বংস করতে, কী নির্লজ্জভাবে সত্যকে উল্টো পথে পরিচালনা করতে পারেন! এভাবেই উগ্র জঙ্গিদের একের পর এক হত্যাকাণ্ড ও গ্রেনেড হামলার ঘটনাকে লুকানো বা ভিন্ন পথে পরিচালনা করতে জোট সরকার সচেষ্ট ছিল। এই সবকিছু তো বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অজ্ঞাতে হতে পারে না। এর দায় এড়াতে পারেন না বিএনপির নেতৃত্ব। এসব ঘটনা জাতির জন্য একটি ভয়ংকর কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবেই বিবেচিত হবে।
আমরা ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার অধিকতর তদন্ত শেষ করে দ্রুত বিচার ও প্রকৃত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই। একই সঙ্গে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সমবেদনা জানাই।
মতিউর রহমান: সম্পাদক, প্রথম আলো।